সুয়েজ খাল সম্পর্কে সকল তথ্য ও ইতিহাস - বাংলানিবন্ধ
সুয়েজ খাল সম্পর্কে সকল তথ্য ও ইতিহাস - বাংলানিবন্ধ
ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে সুয়েজ খাল। মিশরের সিনাই উপদ্বীপে মরুভূমির বালুর মাঝখান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই সুয়েজ খাল। এখানে দেখা যায় পৃথিবীর অন্যতম এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বিশাল বিশাল সামুদ্রিক জাহাজ ভেসে যায় মরুভূমির মাঝখান দিয়ে। সুয়েজ খাল তৈরি হবার পর ইউরোপ ও ভারতের মাঝে সমুদ্র পথের দূরত্ব কমে যায় প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার অতীতে সমুদ্রপথে ইউরোপ থেকে সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে সময় লাগত প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস আর সুয়েজ খাল তৈরি হবার পর জাহাজগুলোর সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগে মাত্র তিন সপ্তাহ। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১০% সমুদ্র বাণিজ্য শুধুমাত্র সুয়েজ খালের মাধ্যমে হয়ে থাকে। পৃথিবীর অন্যতম সম্পদ সুয়েজখাল সম্পর্কে জানব বাংলা নিবন্ধের আজকের এই পর্বে তো চলুন শুরু করা যাক।
খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক উনিশ শতকে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় সুয়েজ খালের মতোই একটি খাল ছিল। তৎকালীন মিশরের ফেরাউন প্রথম শেসস্প্রিস লোহিত সাগর থেকে নীলনদ পর্যন্ত একটি খাল খনন করার নির্দেশ দেন। এরপর তার পরবর্তী ফেরাউনরা ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে তৎকালীন নৌকা চলাচলের উপযোগী খাল খনন করেন। এ খাল প্রায় ১২০০ বছর পর্যন্ত সচল ছিল কিন্তু তৎকালীন সময়ে শুধু মিশরীয়রায় তাঁদের বাণিজ্যের কাজে এ খাল ব্যাবহার করতে পারত। পরবর্তীতে মরুঝড়ের ফলে এ খালের বেশ কিছু অংশ ভরাট হয়ে বিটার রদ এবং তিমসা রদের সৃষ্টি করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৬ শতকে ফেরাউন নিকো আবার এ খাল খনন করতে চায় কিন্তু কিন্তু সেই প্রকল্প বাস্তবায়ক করতে গিয়ে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। এর প্রায় ১০০ বছর পরে পারস্যের রাজা দারিউস ভূমধ্য সাগরের নিকটবর্তী অংশ খনন করা শুরু করে। এর দুই শতাব্দী পরে দ্বিতীয় টলেমীর আমলে এ খনন কাজ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে পুনরায় মরুভূমির বালিদারা ভরাট হয়ে প্রায় এক হাজার বছর চাপা পড়েছিল খালটি। বর্তমানের সুয়েজ খালটিও টলেমীর আমলের সেই খালের উপর নির্ভর করে তৈরী করা হয়েছে।
চৌদ্দশ আটানব্বই সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা আফ্রিকা মহাদেশের কেপ অব গুড হোপ এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন। ভাস্কো দা গামার আবিষ্কৃত পথে ইউরোপ থেকে ভারতে আসতে সময় লাগত প্রায় চার মাস। এরপর প্রায় 400 বছর ধরে ব্রিটিশ ওলন্দাজ উপনিবেশ এর জাহাজ সমুদ্রপথে রাজত্ব করে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি শুরু হওয়া শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিরাট পরিবর্তন আসে। পুরনো অভিজাত শ্রেণীর পতন ও নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব এর ফলে দূরপ্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের বাণিজ্য তখন বিলাসিতার গণ্ডি ছাড়িয়ে অতি জরুরী বিষয়ে পরিণত হয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড সহ সমগ্র ইউরোপে সৃষ্ট কলকারখানার জন্য দরকার পড়ে নানা রকমের কাঁচামাল। তাঁদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল বিভিন্ন ধরণের খনিজ আকরিক, পাট ও তুলা। ঠিক একই সময়ে সমুদ্রগামী জাহাজের নির্মাণ পদ্ধতিতেও আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এ সময় প্রাচীন কাঠের জাহাজের বদলে আধুনিক স্টিল এর বিশাল বিশাল জাহাজ তৈরি হতে থাকে। এসব স্টিলের জাহাজ ভারত তথা এশিয়ার থেকে প্রচুর কাঁচামাল নিয়ে যেতে সক্ষম ছিল। কিন্তু সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে এসব আধুনিক জাহাজের যাত্রায় অনেক বেশি সময় লাগত তাই বাধ্য হয়ে তখন ইউরোপের মনোযোগ যায় সুয়েজ উপকূলে।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মিশর অভিযানে আসার পর ভূমধ্যসাগর লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। কিন্তু ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগরের উচ্চতা 10 মিটার বেশি থাকায় সে সময় খাল খননের চিন্তা বাদ দেয়া হয়। পরবর্তীতে লেসেপস ফার্দিনান্দ নামের একজন ফরাসি প্রকৌশলী সুয়েজ খাল খননের উদ্যোগ নেন। সুয়েজ খাল খনন করতে ১৮৫৮ সালের ডিসেম্বরে সুয়েজ খাল কোম্পানি গঠন করা হয়। লেসেপস চেয়েছিলেন সুয়েজ খাল কোম্পানি যেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে এবং খাল প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তি অনুযায়ী সকল দেশ শান্তিও যুদ্ধকালীন সময়ে বৈষম্যহীনভাবে সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে। কিন্তু তখন ব্রিটিশ সরকার সুয়েজ খাল খননের বিরোধিতা শুরু করে। ব্রিটিশরা ভাবছিল যেহেতু ফরাসিরা এই খাল খননের দায়িত্বে রয়েছে তাই খাল খনন সম্পন্ন হবার পর ফরাসিরা হয়তো পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ব্রিটিশদের এ পথে যাতায়াত করতে দিবেনা। এছাড়াও ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজত্বে অন্য কোন ইউরোপীয় দেশকে ভাগ দিতে চাইনি। খাল খনন যাতে বাধাপ্রাপ্ত হয় সেজন্য ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংক কে ব্রিটিশ সরকার এ প্রকল্পে ঋণ দিতে নিষেধ করে। সেসময় মিশর ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। তৎকালীন মিশরের শাসক মোহাম্মদ সাঈদ পাশা ইউরোপের কিছু ব্যাংক থেকে অতি উচ্চ সুদের টাকা ঋণ নিতে সক্ষম হন। ১৯৬৩ সালে মোহাম্মদ সাঈদ এর মৃত্যুর পর তার ভাতিজা ইসমাইল পাশা মিশরের ক্ষমতায় আসেন। ১০ বছর খননের পর ইসমাইল পাশার আমলেই সুয়েজ খালের নির্মাণ শেষ হয়।
সুয়েজ খাল চালু হবার পরে খালের মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলো লাভবান হলেও বহু দেনার দায়ে মিশরের অর্থনীতি উল্টো দেউলিয়া হওয়ার পথে আগাতে থাকে। তখন ইসমাইল পাশা সুয়েজ খালের ৫০% শেয়ার বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ঘোষণার সাথে সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেইলি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বা রানি কারো কাছ থেকে কোন আনুষ্ঠানিক অনুমতি না নিয়েই ২ কোটি ডলারে সুয়েজ খালের অর্ধেক শেয়ার কিনে নেয়। এরপর বেঞ্জামিন রানী ভিক্টোরিয়া কে চিঠি লিখে বিষয়টি জানায়। বৃটেনের প্রথম এবং একমাত্র ইহুদি এ প্রধানমন্ত্রী চিঠিতে শুধু একটি লিখেছিল ম্যাডাম আপনি এখন সুয়েজ খালের মালিক। যে ব্রিটিশরা সুয়েজ খাল খননের শুরু থেকেই এ প্রকল্প বন্ধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছে সেই ব্রিটিশরাই পরবর্তীতে কৌশলে সুয়েজ খালের অর্ধেকের মালিক বনে যায়।
এই শেয়ার কেনার পর থেকে ব্রিটিশরা মিশরের আভ্যন্তরীণ সকল বিষয়ে নিয়মিত নাক গলাতে শুরু করে এরপর ১৮৮২ সাল থেকে দীর্ঘ ৭৫ বছর ব্রিটিশরা মিশর দখল করে রাখে।
১৯৫৬ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিশরের ক্ষমতায় আসে জামাল আবদেল নাসের। তিনি ক্ষমতায় আসার পরপরই সুয়েজ খাল কে জাতীয়করণ করেন এর প্রেক্ষিতে তৈরি হয় সুয়েজ সংকট। তখন ব্রিটেন, ফ্রান্স, এবং ইসরাইলের যৌথ সেনাবাহিনী মিশর দখল করে নেয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্রের ভোটে সুয়েজ খালকে মিশরের সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় থেকে ১৯৭৫সাল পর্যন্ত প্রায় আট বছর সুয়েজ খালে জাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। এসময় মিশর ইচ্ছাকৃতভাবে চল্লিশটি জাহাজ ডুবিয়ে সুয়েজ খালকে নৌ চলাচলের অনুপযোগী করে রাখে।
১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল খননের কাজ সম্পন্ন হবার পর এটি সমগ্র বিশ্বের বাণিজ্যিক নৌপথে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটি তৎকালীন সময়ে বিশ্ব বাণিজ্যের চেহারাই বদলে দেয়। এটি ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে যাতায়াতের জন্য এক বিশাল শর্টকাট তৈরি করে। তার আগে ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত যেতে অথবা আসতে সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরতে হতো। সুয়েজ খাল তৈরি হবার পর ইউরোপ ও ভারতের মাঝে সমুদ্রপথের দূরত্ব কমে যায় প্রায় ৭০০০ কিলোমিটার। এই খাল তৈরি হবার পর পৃথিবীটা যেন ছোট হয়ে আসে। শুরুতে সুয়েজ খালের দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ কিলোমিটার এবং গভীরতা ছিল ৮ মিটার। বেশ কিছু সংস্কার ও সম্প্রসারণ এর পর ২০১০ সালের হিসাব মতে এর দৈর্ঘ্য ১৯০.3 কিলোমিটার গভীরতা ২৪ মিটার এবং সর্বনিন্ম সরু স্থানের প্রস্থ ২০৫ মিটার। সুয়েজ খাল উদ্বোধন হয় ১৮৬৯ সালে। এটি উদ্বোধনের সময় এর প্রস্থ ও গভীরতার ক্ষেত্রফল ছিল ৩০০ বর্গমিটার পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এটি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৬ সালে জাতীয়করণের সময় এর ক্ষেত্রফল হয় ১২০০ বর্গমিটার। পরবর্তীতে সুয়েজ খালকে মিশরীয়রা ১৮০০ বর্গমিটারে উন্নীত করে।
১৯৭৫ সালে পুনরায় চালু হবার পর সমুদ্রগামী জাহাজ গুলোর আকৃতিতে বিশাল পরিবর্তন আসে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত সুয়েজ খালের প্রস্থ গভীরতা নিয়মিত বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এছাড়াও খাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিদিনই সুয়েজ খালের কোনো না কোনো অংশের বালি ড্রেসিং করা হয়। সুয়েজ খাল একটি এক লেন বিশিষ্ট খাল হওয়াতে সুয়েজ খাল দিয়ে একের অধিক জাহাজ পাশাপাশি যাতায়াত করতে পারে না। তবে জাহাজের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে খালের পাশে পাঁচটি বাইপাস ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে সুয়েজ খাল থেকে থেকে বছরে প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ আয় করে থাকে মিশর। মিশর সুয়েজ খালের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকলেও এটি সমগ্র পৃথিবীর জন্য এক অনন্য সম্পদ কারণ বিশ্বের প্রায় ১০% সমুদ্র বাণিজ্য হয়ে থাকে শুধুমাত্র সুয়েজ খালের মাধ্যমে। অতীতে সুয়েজ খালের মত সরু প্রাকৃতিক এক প্রবাহের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত ছিল মৃতসাগর। পৃথিবীর অন্যান্য সাগরের তুলনায় মৃত সাগরের পানি দশগুণ বেশি লবণাক্ত হওয়ার কারণে এ জলে কোন উদ্ভিদ বা প্রাণী বাঁচতে পারে না আর তাই এর নাম দেয়া হয়েছে মৃত সাগর। অত্যধিক লবণের উপস্থিতির কারণে মৃত সাগরের পানির প্লবতা এতই বেশি যে এখানে আপনি অনায়াসে হাত-পা ছড়িয়ে ভেসে থাকতে পারবেন। আপনি যদি মৃত সাগর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান তাহলে আমাদেরকে কমেন্টে জানান। ধন্যবাদ, আপনার দিনটি শুভ হোক। Erotic stories
No comments